রুহুল আমিন রুকু, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ
“যার বাড়ী ভাঙ্গে সেই বোঝে বাড়ী ভাঙ্গার কী যে বেদনা” ধরলা নদীর ভাঙ্গনে গত ৭ বছরে ৫ বার বসতবাড়ী হারানো এক কৃষক আফতার আলী আক্ষেপ করে বলেছিলেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের ফজলের মোড়ে ভাঙ্গনের শিকার হয়ে এক বছর পূর্বে বাঁধ রাস্তায় আশ্রয় নেয়া তার বাড়ী শেষ রক্ষা হলো না। চলতি বছরে এবারের ভাঙ্গনে বিলীন হওয়া স্থান থেকে সরে যেতে হলো পার্শ্ববর্তী নওয়াবশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই। একই গ্রামের ঝালমুড়ি কয়সার আলী দুই বার ভাঙ্গনের শিকার হয়ে অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছে। সদর উপজেলার মোগলবাসা ইউনিয়নের চর কৃষ্ণপুর গ্রাম প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে এর কারণ হলো নদী ভাঙ্গন। গত ৪ বছরের মধ্যে এবারের ভাঙ্গন ভয়াবহ ছিল। ধরলা নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে আবাদী জমি, বসতভিটা, স্থানীয় জামে মসজিদ ও চর কৃষ্ণপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্থানীয় ফারুক মিয়া জানান, ভাঙ্গনের শিকার হয়ে বসতভিটা সহ আবাদী জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন পরিবার সহ আশ্রয় নিয়েছি পার্শ্ববর্তী বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রতে। ডাক্তার রোস্তম আলী জানান, এবারের ভয়াবহ ভাঙ্গনে চর কৃষ্ণপুর গ্রাম প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। নয়ারহাট বাজারের মোবাইল ব্যবসায়ী এরশাদুল হক জানান, পৈত্রিক বসতভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় বাড়ীর আসবাবপত্র সহ পরিবারের লোকজন নৌকা যোগে নয়ারহাট বাজার সংলগ্ন বাঁধ রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। এলাকার শত শত পরিবার ভাঙ্গনের শিকার হয়ে মোগলবাসা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের চর সিতাইঝাড় কলাবাগান নামক স্থানে কোন রকম অন্যের জমিতে ঠাই নিয়েছে। উলিপুর উপজেলা নদ-নদী দ্বারা বেষ্টিত বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের আকেল মামুদ মিয়াজী পাড়া, কবিরাজ পাড়া ও ব্যাপারী পাড়া এবারের ভাঙ্গনে ধরলা নদী কেড়ে নিয়েছে অনেকের বসতভিটা ও আবাদী জমি। ভাঙ্গনের শিকার কবিরাজ পাড়া গ্রামের মৃত- এছাহাক আলীর পুত্র শাহজামাল হক জানান, দু’বার নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে ফকির হয়ে গেছি। কোথায় স্থান নিবো তার কোন জায়গা পাচ্ছি না। ব্যাপারী পাড়া গ্রামের মৃত- জব্বার আলীর পুত্র মোজাম্মেল হক দু’বার ধরলা নদীর ভাঙ্গনের শিকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। কবিরাজ পাড়া গ্রামের মোঃ এছাহাক আলীর পুত্র তাইজুল ইসলাম দু’বার ধরলা নদীর ভাঙ্গনের শিকার হয়ে পার্শ্ববর্তী মিয়াজী পাড়ায় অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে ভাঙ্গন কবলিত পরিবারগুলো জানান, সরকারী ভাবে কোন বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এলাকায় কোন খোঁজখবর নেয়নি। ভাঙ্গনের শিকার এমন আরো অনেকেই আছেন যারা প্রতিবছর বসতভিটা হারিয়ে কখনও আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের জমিতে কিংবা কখনও রাস্তায়। প্রাকৃতিক নিয়মে নদী ভাঙ্গনে প্রতিবছর ঘর বাড়ী হারায় শত শত মানুষজন। ভাঙ্গন প্রবল নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম ধরলা নদী। তবে প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে ধরলা ভাঙ্গনের কারণ হিসেবে যুক্ত হয়েছে মানুষের কর্মকান্ড। মানুষের লোভ কিভাবে একটি নদীকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। বছরের পর বছর অবৈধ ভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন করার ফলে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে এই নদীর গতিপথ। আর ভাঙ্গনের ফলে ঘর বাড়ী হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ধরলা নদী বাংলাদেশের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। কুড়িগ্রামের মধ্যদিয়ে বয়ে গেলেও এই নদী বাংলাদেশে ঢুকছে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলা দিয়ে এবং আবার ভারতে প্রবেশ করে ফিরে এসেছে কুড়িগ্রাম দিয়ে। নদীটি বাংলাদেশ অংশে ৭৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বেশির ভাগ অংশেই বয়ে গেছে পাটগ্রামের উপরদিয়ে। কুড়িগ্রামে প্রাকৃতিক নিয়মে ধরলা নদীতে ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলছে। ধরলা নদীর যে অবস্থা দাড়িয়েছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ধরলা নদীর কথা এসেছে উত্তর বঙ্গের খুব সুপরিচিত একটি ভাওয়াইয়া গানে শিল্পি আব্বাস উদ্দিন ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে শিরোনামে এই গানটি গিয়েছেন ধরলা নদীর পাড়ে ফাঁদে আটকে পড়া একটি বগ নিয়ে। কিন্তু এখন ধরলা নদীর পাথর ও বালু উত্তোলন করায় ফাঁদে আটকে গেছে নদীর পাড়ের হাজার হাজার মানুষ। বর্তমান ভাঙ্গনের শিকার হয়ে আকেল মামুদ গ্রাম যেন ছোট বড় বস্তি গ্রাম হয়ে গেছে। ঘর বাধা সাজানো সংসার, দু’চোখে দেখে স্বপ্ন মনে বড় আশা নিয়ে সাজিয়ে তোলে মনের আনন্দের সংসার। জীবনের পথগুলো এগিয়ে নিতে শুরু করে চরাঞ্চল সহ নদীর তীরবর্তী মানুষজন। কিন্তু প্রতিবছর নদী কেড়ে নেয় তাদের বসতভিটা। কেড়ে নেয় সাজানো সংসার, নিঃস্ব করে দেয় ওদের। এ গ্রামের শত শত পরিবারের সাজানো ঘর সংসার নিমিশেই ধরলা নদী কেড়ে নেয়ায় গৃহ হারা অনেকের দিন কাটছে খোলা আকাশের নিচে। চোখের সামনে ঘর বাড়ির সাথে সাজানো সংসার ভেঙ্গে চুরমার হওয়ায় চোখের জলে বুক ভেজছে তাদের দু’চোখে স্বপ্ন আর বুক ভরা আশাগুলো। এখন তাদের স্বপ্ন কোথায় গেলে আমরা ভাঙ্গন থেকে মুক্তি পাবো। সায়াদ আলী, নুর ইসলাম, মকবুল হোসেন, আহাদ আলী খলিফা, জাকির হোসেন, সৈয়দ আলী কাসাই, ডাক্তার খয়বার আলী, শাহ আলম সহ অনেকের সংসার এক সময় ভালো চললেও বর্তমানে তাদের সংসার জীবন নদী ভাঙ্গনের কারণে অনেক কষ্টে কাটছে। ডাক্তার খয়বার আলী এ প্রতিবেদককে জানান, গত ১০/১৫ দিন থেকে খুঁদিরকুটি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে ৩০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছি। বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশন সংকটে পড়েছি। অনেক পরিবার বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। এলাকাবাসী জরুরী ভিত্তিতে ভাঙ্গন রোধে এবং গৃহহীন পরিবারগুলো সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।