রংপুর প্রতিনিধি ॥ পড়াশুনার পাশাপাশি সখের বশে কোয়েল পাখি পালন করে ৬ মাসেই বেকারত্ব দূর করেছেন মিজানুর রহমান। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের কাচনা হাজিপাড়া গ্রামের জহির উদ্দিনের ছেলে মিজানুর রহমান। চলতি সালের জানুয়ারিতে শখের বসে শুরু করেন কোয়েল পাখির খামার। এ লক্ষ্যে তিনি তার বসতবাড়ির সামনে ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ছোট আকারের (১০ ফিট লম্বা) ঘর তোলেন। এরপর সেই ঘরের ভেতর কাঠ, বাঁশ ও নেট দিয়ে তিনটি ছোট খাঁচা তৈরি করেন। খাঁচা তৈরির কাজে তার খরচ হয় প্রায় ৬ হাজার টাকা। বন্ধুদের মাধ্যমে খবর নিয়ে বাচ্চা ফোটানোর ডিম কেনার জন্য চলে যান গাইবান্ধা জেলার আলমিজান ইনকিউবেটর ফার্মে। সেখান থেকে তিনি ৩ টাকা পিস দরে ৩০০টি ডিম নিয়ে আসেন। এর আগে তিনি ঢাকা থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে নিয়ে আসেন ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর মেশিন। ডিম নিয়ে এসে তিনি ওই মেশিন দিয়ে কোয়েল পাখির বাচ্চা ফোটান। এতে সময় ব্যয় হয় প্রায় ২৩ দিনের মতো। কিন্তু তার ৩০০টি ডিমের মধ্যে ৫০টি ডিম নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চা বের হয় ২৫০টি। এরমধ্যে আবার ১০০টির মতো হয় পুরুষ বাচ্চা। বাকি ১৫০টি মেয়ে বাচ্চা। কয়েকটি ছেলে বাচ্চা রেখে বাকীগুলো বিক্রি করে দেন তিনি। আর মেয়ে বাচ্চাগুলো দিয়ে শুরু করেন তার শখের কোয়েল খামার। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি মিজানুরকে। এখন তার খামারে প্রায় ৫ শতাধিক কোয়েল পাখি লালন-পালন হচ্ছে। এরমধ্যে প্রতিদিন ডিম দেয় প্রায় সাড়ে ৩০০ কোয়েল পাখি। তিনি প্রতিটি ডিম বিক্রি করেন ২ টাকা পিস দরে। প্রতিদিন তার খামারে কোয়েল পাখির খাবার বাবদ খরচ হয় ৩৫০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা এবং সঞ্চয় হয় প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত। ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজ থেকে প্রাণি বিজ্ঞানে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স পড়ুয়া মিজানুর কোয়েল পাখি পালন শুরু করেন নিতান্তই শখের বসে। কিন্তু শখের বসে করা এ খামারেই দূর হয়েছে তার বেকারত্বের জীবন। এখন পড়াশুনার পাশাপাশি এ খামার থেকে আয় করে সহযোগিতা করছেন বাবাকে। সূত্রে জানা যায়, কোয়েল পাখি মাঝারি আকারের এক শ্রেণীর ভূচর পাখি। খাদ্য উপযোগী যত ডিম ও মাংস আছে তার মধ্যে কোয়েল পাখির ডিম ও মাংস উত্তম ও সুস্বাদু; যা মানবদেহের জন্য অধিক পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত। এতে এতো বেশি পরিমাণ খাদ্যপুষ্টি আছে, যা অন্য কোন মাংস বা ডিমে নেই। কোয়েলের মাংস ও ডিমে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল ও এনজাইম। কোয়েলের ডিম হার্ট ডিজিজ, কিডনি সমস্যা, অতিরিক্ত ওজন কমানো, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, পাকস্থলী ও ফুসফুসের নানা রোগ, স্মৃতিশক্তি রক্ষা, রক্তের পরিমাণ কমে যাওয়া, উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে। কোয়েলের ডিম প্রাণীজ খাদ্যদ্রব্য হলেও এরমধ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, এনজাইম ও এমাইনো এসিড এমন মাত্রায় থাকে যে এ ডিম খেলে শরীরের সব ধরনের পুষ্টির অভাব পূরণ হয় এবং শরীরের কার্যক্ষমতা বাড়ে। শিশুদের মানসিক, শারীরিক ও বুদ্ধিমত্তা বিকাশে যেমন কোয়েলের মাংস ও ডিম সহায়ক হিসেবে কাজ করে, তেমনি ডায়াবেটিস রোগীদেরও অত্যন্ত উপযোগী খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এর মাংস ও ডিম। মাস্টার্স পরীক্ষার্থী এ ছাত্র জানান, কোয়েল পাখির মাংস ও ডিম মানুষের শরীরে কিডনী, লিভার ও হৃদপিন্ডের কার্যক্ষমতা উন্নত করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে অনেক কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এর মাংস ও ডিম দেহে অধিক পুষ্টি যুগিয়ে শারীরিক দূর্বলতা দূর করে। কোয়েল খামারী মিজান বলেন, কোয়েল পাখির খামার করে যে এভাবে এতো দ্রুত লাভবান হবো, তা ভাবতেও পারিনি। শখের বসে করা আমার এ খামারের আয় থেকে এখন আমি আমার নিজের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে যাবার পাশাপাশি বাবার সংসারেও সহযোগিতা করছি। আমাকে দেখে আরো কয়েকজন কোয়েল পাখির খামার গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তারা আমার কাছে মাঝে মাঝে এসে পরামর্শও নিয়ে যাচ্ছে। কোয়েল পাখির চিকিতসা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রাণি বিজ্ঞানের এ ছাত্র বলেন, আমি তো প্রাণি বিজ্ঞানের ছাত্র, তাই এগুলোর চিকিতসা দিতে তেমন বেগ পেতে হয়না। তবে যখন কোন সমস্যা বেশি কঠিন বলে মনে হয়, তখন স্থানীয় পশু চিকিতসকদের কাছ থেকে পরামর্শ নিই। কোন প্রশিক্ষণ আছে কি-না জানতে চাইলে মিজান বলেন, তেমন কোন প্রশিক্ষণ নেই। তবে ২/৩ বছর আগে এসকেএস ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিও থেকে ৬ মাস মেয়াদী একটি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম গবাদী পশু পালনের উপর। তাছাড়া আর কোন প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার সুযোগ পাইনি। উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো.সিরাজুল হক বলেন, কোয়েল পাখির খামার একটি লাভজনক খামার। একে গরীবের খামার বলা যায়। এ খামার করতে তেমন খরচ হয়না। অল্প পুঁজিতে এ খামার করে অল্প দিনের মধ্যেই লাভবান হওয়া যায়। জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ শাহ জালাল খন্দকার বলেন, কোয়েল পাখির রোগবালাই খুবই কম হয়। তাই প্রতিপালন করা যায় সহজেই। এ পাখি ৬ থেকে ৭ সপ্তাহের মধ্যে ডিম দেয়া শুরু করে। তিনি বলেন, রংপুর জেলার ৮ উপজেলায় ছোট-বড় মিলে ৬৩০টি খামার গড়ে ইঠেছে। এ প্রাণিটি বাড়ীর গৃহিণীরা অনায়াসে প্রতিপালন করতে পারে। প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর কারিগরি প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সহায়তা দিয়ে আসছে। কোয়েল পাখি প্রানিজ আমিষ সরবাহে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।