:::ইয়াহিয়া নয়ন:::
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই ভূরাজনীতিতে নতুন মোড় নিতে চাচ্ছে তালেবান। তারা সরাসরি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সশস্ত্র সংগঠনটির মুখপাত্র সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, চীনকে তারা আফগানিস্তানের বন্ধু মনে করে। একই সঙ্গে তারা এও অঙ্গীকার করেছেন, জিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলিমদের আফগানিস্তানের মাঠিতে ঠাঁই দেবে না তালেবান। এমন দিনে তারা এই ঘোষণা দিল, যেদিন কান্দাহার কনস্যুলেট থেকে ৫০ কর্মকর্তাকে ফিরিয়ে নিলো ভারত।
চীন সরকার তার মুসলিম উইঘুর অধ্যুষিত জিনজিয়াং প্রদেশের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে থাকে। আফগানিস্তানের সঙ্গে জিনজিয়াংয়ের আট কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এ বিষয়ে বেইজিংকে আশ্বস্ত করতে চাচ্ছে তালেবান। তবে চীন এখনো মনে করে, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় এলে ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) নামে যে সংগঠনটি উইঘুরদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে সমর্থন দেয়, তারা আফগানিস্তানে আস্তানা গাড়বে। বেইজিং মনে করে, সশস্ত্র গোষ্ঠী ইটিআইএম হলো আল কায়দার একটি শাখা।
চীনের এই উদ্বেগ দূর করতে উদ্যোগী হয়েছে তালেবান। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন বিষয়টি পরিস্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, চীনকে বন্ধু মানে আফগানিস্তান। যত শিগগিরই সম্ভব আফগানিস্তান পুনর্গঠনে বেইজিংয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায় তালেবান। আগে তাদের সঙ্গে তালেবান প্রতিনিধিদের কয়েক দফায় আলোচনা হয়েছে। চীনের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
তালেবানের এই মুখপাত্র আরো বলেন, ‘চীন আমাদের বন্ধু দেশ। পুনর্গঠন ও উন্নয়ন কার্যক্রমে আমরা তাদের স্বাগত জানাই। তারা যদি বিনিয়োগ করে, আমরা অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।’ এই মুহূর্তে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের কঠোর সমালোচনা করেছে চীন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশটির স্থিতিশীলতার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বেইজিং। আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের পরিণতি ও সম্ভাব্য অবস্থা সম্পর্কে ইসলামাবাদ ও বেইজিংয়ের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ওই আলোচনায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, ‘উভয়ের (চীন-পাকিস্তান) আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে দাঁড়ানো দরকার। আফগানিস্তানের সমস্যাগুলো দুই দেশের জন্য নৈমিক্তিক চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়ার দিক থেকে এটি বড় চ্যালেঞ্জ।’
তালেবান চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইলে এই দুদেশ তাদের ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। তালেবান আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসলে এই অঞ্চলের জঙ্গি সংগঠনগুলো যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বেইজিং ও ইসলামাবাদ। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা আল কায়দার শাখা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এদিকে এমন দিনে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে তালেবানের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো, যেদিন আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশের কনস্যুলেট থেকে দেশে ফিরলেন ৫০ ভারতীয় কর্মকর্তা। কান্দাহারের চারপাশের অনেক শহর তালেবান দখল করে নেওয়া কান্দাহারের প্রধান শহরে নিরাপত্তা সংকট বাড়ছে।
কান্দাহারের আশপাশে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান এলাকাগুলো দ্রুত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে তালেবান যোদ্ধরা, পাশাপাশি আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলেও বড় ধরনের নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে তারা। এ পরিস্থিতিতে কান্দাহার থেকে কূটনীতিক ও কর্মীদের সরিয়ে আনলো ভারত। এর আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, আফগানিস্তানের অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর সতর্কভাবে নজর রাখছেন তারা এবং ভারতীয় নাগরিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ওপর এর প্রভাবের দিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়টির মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।’ প্রায় ২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধের ইতি টেনে আগস্ট মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে।
আফগানিস্তানের চারশ জেলার মধ্যে ২১৬টি জেলা তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে কাবুল সরকার। আফগান সরকারের প্রশাসনিক সংস্কার বিষয়ক কমিশনের চেয়ারম্যান ও তালেবানের সঙ্গে সরকারি আলোচক দলের সদস্য নাদের নাদেরি রাজধানী কাবুলে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, দেশের ২৯টি প্রদেশের ২১৬টি জেলা বর্তমানে তালেবানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব জেলার এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ তালেবান শাসনে বসবাস করছেন কিন্তু তারা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
সম্প্রতি বিদেশে গিয়ে পাকিস্তানকে একহাত নিলেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। দেশটিতে চলমান সংঘাতে তালেবানকে সহযোগিতা করার অভিযোগ তুললেন ইমরান খানের দেশের বিরুদ্ধে। উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে তিনি পাকিস্তানের তীব্র সমালোচনা করেন।
আন্তর্জাতিক এ সম্মেলনে পাকিস্তানের তীব্র সমালোচনা যেমন করেছেন তেমনই আফগানিস্তানে শান্তি ফেরাতে দেশটির সাহায্যও চান ঘানি। তিনি পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানান, দেশটি যেন তার প্রভাবকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে এর মাধ্যমে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং শত্রুতা দূর করতে সাহায্য করে। ঘানি তার বক্তব্যে বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা অনুযায়ী, তালেবানের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য গত মাসেই পাকিস্তান এবং অন্যান্য জায়গা থেকে আফগানিস্তানে ১০ হাজারের বেশি মানুষ এসেছেন।
এসময় তালেবানেরও তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। তিনি বলেন, তালেবান বলেছিল, তারা শহর এবং প্রাদেশিক রাজধানীগুলোতে হামলা চালাবে না। কিন্তু তারা কথা রাখছে না। তারা শহরে এবং প্রদেশের রাজধানীগুলোতে অব্যাহতভাবে হামলা চালাচ্ছে। সম্মেলনে তালেবান এবং তার সমর্থকদের প্রতি কঠোর বার্তা দিয়েছেন ঘানি। তিনি বলেন, আমরা তালেবান এবং তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত আছি। রাজনৈতিক সমাধানই এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র- তারা এটা না বোঝার আগ পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।
যুদ্ধ বন্ধে তালেবানকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে ঘানি বলেন, এই যুদ্ধ বন্ধে আফগান সরকারের সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি ধ্বংসাত্মক সাম্প্রতিক হামলা বন্ধে তালেবানের প্রতি আহ্বান জানাই।
আফগান প্রেসিডেন্টের আহ্বানে কতটুকু সাড়া দেবে তালেবান তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে ইতোমধ্যে তালেবানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশটির প্রায় ৮৫ শতাংশ এলাকা এখন তাদের দখলে রয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়ছে সংগঠনটি।
ওদিকে তালেবান সেনাদের হাতে এখন রাশিয়ার তৈরি অস্ত্র দেখা যাচ্ছে। রাশিয়া অনেক আগে থেকেই তালেবানকে সব ধরনের সহায়তা করে যাচ্ছে। আসলে ওপরে ওপরে যে যাই বলুন,তালেবানদের সাথে এখন চীন,রাশিয়া এবং ইরান রয়েছে। পাকিস্তান মাঝখান থেকে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত লাফাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন শেষ পর্যন্ত ক্ষতিটা পাকিস্তানেরই হবে। মনে রাখতে হবে যে,চীন রাশিয়া এবং ইরান এক জোট। তারা সাংহাই চুক্তি নামে এক অর্থনৈতিক আবদ্ধ। সবটা দেখার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে। আপাতত এ টুকু বলা যায়,ভিয়েতনামের পর আমেরিকা আফগান থেকেও পরাজিত হয়ে ফিরলো।
লেখক : সাংবাদিক,কলাম লেখক।
ঢাকা,২৪ জুলাই ২০২১