এম এ হাসান, কুমিল্লাঃ
দেশের বহুল আলোচিত ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার মামলায় প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৬ জনের ফাঁসির রায় দিয়েছেন আদালত।
এদিকে উক্ত রায় কে ঘিরে সারাদেশে ছিলো টান টান উত্তেজনা, সরজমিনে ফেনির আদালত চিত্র ছিলো থমথমে।আজ বৃহস্পতিবার ২৪ই অক্টোবর সকাল ১১ টার দিকে ফেনী জজকোর্টের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইবুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ উক্ত রায় ঘোষণা করেন। বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মী দের নিকট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়েছেন বলেই এত দ্রুত সময়ের মধ্যে রায় দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
এসময় নোমান আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের পরিবারের পাশে ছিলেন বলেই আমরা এখনো টিকে আছি। তিনি নিজে আমাদের পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন। আমার বোন হত্যার বিচারের দায়িত্ব তিনি নিজে নিয়েছেন। তার আন্তরিকতার কারণেই সর্বস্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আন্তরিকভাবে কাজ করেছে। আমাদের পুরো পরিবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
উল্লেখ্য ঘটনার সূত্রপাত হয় চলতি বছরের ২৭ মার্চ ওইদিন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেছিলেন নিহত নুসরাতের মা শিরিন আখতার। সেদিনই অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর তার অনুগত কিছু ক্যাডার জনমত গঠন করে সিরাজকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য। তারা সিরাজকে মুক্ত করতে রাস্তায় আন্দোলনও করে।৩ এপ্রিল খুনিরা সিরাজের সঙ্গে জেলখানায় পরামর্শ করে এসে ৪ এপ্রিল মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুন করার পরিকল্পনা নেয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে খুনিরা পরিকল্পিতভাবে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতকে হত্যার চেষ্টা চালায়। ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই চিকিৎসা হয় নুসরাতের।
এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল ৮ জনকে আসামি করে ও অজ্ঞাতপরিচয় বোরকা পরা চারজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তর করা হয় ১০ এপ্রিল। সেদিন রাতেই মারা যান নুসরাত। মৃত্যুর আগে ডাইং ডিক্লারেশন দিয়ে যায় সে- তার সেই ডিক্লারেশনের ক্লু ধরেই এগোতে থাকে মামলা। এক এক করে গ্রেফতার করা হয় আসামিদের।১১ এপ্রিল নুসরাতকে আনা হয় তার বাড়িতে।
সোনাগাজী সাবের পাইলট হাইস্কুল মাঠে নামাজে জানাজার পর সমাহিত করা হয় কবরে। সেদিন নুসরাতের জানাজাটি ছিল লোকে লোকারণ্য। লাখো মানুষ তার জানাজায় অংশ নিয়ে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে।এরপর একে একে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয় ২১ জনকে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ১২ জন। ২৮ মে চার্জশিট দাখিল করা হয়। আদালত পাঁচজনকে বাদ দিয়ে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করে ১৬ জনকে।
নুসরাত হত্যায় পুলিশের অবহেলার অভিযোগে ১৩ মে প্রত্যাহার করা হয় ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকার নুসরাতের থানায় হেনস্থা হওয়ার ভিডিওটি প্রকাশ হওয়ার পর ৮ মে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি ) মেয়াজ্জেমসহ পুলিশের দুই এসআইকে বহিষ্কার করা হয় ৮ মে।
এরপর তার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়।
১৬ জুন তাকে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।১০ জুন অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। এরপর ২০ জুন চার্জ গঠন হয়। ২৭ জুন থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়, ৯০ জন সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দেন মোট ৮৭ জন।
দীর্ঘ ৪৭ দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্য দিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তি-তর্ক গ্রহণ করা হয়।এদিকে রায় ঘোষণার পর পরই ফেনীর আদালত প্রাঙ্গণে কৃতজ্ঞচিত্তে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে।সকলে এই দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি প্রদানে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।